‘যুদ্ধে রাশিয়ানরা এমনই করে, এটাই চিরকালীন’

ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান ১০ দিনের উপরে পার করেছে। প্রথমদিকে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন, এ যুদ্ধে দ্রুত জয় চাইবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যেকোনো মূল্যে নিজ বাহিনীর বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে চাইবেন।

কিন্তু, সে ধারণা অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। উল্টো মনে হচ্ছে, রাশিয়ার এই নেতা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কিছু লড়াইয়ে প্রচণ্ড হার বা সামরিক-বেসামরিক জীবনহানি নিয়ে মোটেই শঙ্কিত নন। পুতিন বলেছেন, ‘তাদের যুদ্ধ ঠিকঠাক মতোই চলছে’। পুতিনের লক্ষ্য সামগ্রিক যুদ্ধে জয়; আর সেজন্য তিনি ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিতেও প্রস্তুত।

সামরিক ঐতিহাসিক এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সাবেক কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা জন আর.শিন্ডলার ইউক্রেনে রাশিয়ার হামল নিয়ে এমনটাই ব্যাখ্যা করেন ।

পত্রপত্রিকা ও নানা সামাজিক মাধ্যম, টুইটারে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন রণাঙ্গন বিশ্লেষকরা। রাশিয়া বিরোধী পশ্চিমা জনতা ও গণমাধ্যম যুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও ও ছবি আপলোড করে চালাচ্ছে রুশ বাহিনীর বিপর্যয় নিয়ে অনুমান নির্ভর পর্যালোচনা।

এ বিষয়ে নিজ পর্যবেক্ষণে শিন্ডলার বলেন, “টুইটারে করা পোস্ট দেখে মনে হয় ইউক্রেনে রুশ বাহিনী বিভ্রান্ত, বিশৃঙ্খল এবং ক্ষেত্রবিশেষে মাতালের মতো তাদের চলাফেরা। কিন্তু, ভুলে গেলে চলবে না ১৮১৪ সালে যখন তারা প্যারিসে পৌঁছে গিয়েছিল এবং ১৯৪৫ সালে যখন তারা বার্লিন অধিকার করেছিল- তখনও তারা এমনটাই করেছে। কাজেই এখনই সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে খুব বেশি আস্থা রাখবেন না। যুদ্ধে রাশিয়ানরা এমনই করে, এটাই চিরকালীন।”

প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক স্যার অ্যান্টনি জেমস বিভোর তার লেখা এক বইয়ের মুখবন্ধে স্টালিনগ্রাদের লড়াই নিয়ে রাশিয়ান কবি ফিয়োদর ইভানোভিচের উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “রাশিয়াকে শুধু বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না।”

এখানেই পশ্চিমা দুনিয়ার ব্যর্থতা। তাদের কাছে পুতিন একজন উন্মত্ত, ক্ষ্যাপাটে নেতা, যাকে সাঁড়াশির মতো নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাগে আনা যায়। অর্থনীতির ওপর সর্বোচ্চ চাপ পড়লেই তিনি সুবোধ বালকের মতো যুদ্ধযাত্রায় ইতি টানবেন- এমনই সে বিশ্বাস।

এক্ষেত্রে শিন্ডলার তার ফাউন্ডেশন ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস সংস্থার বিশ্লেষক বন্ধু বিল রজ্জিও’র লেখা একটি নিবন্ধের কথা উল্লেখ করেন। গেল সপ্তাহে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি মেইলে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে রজ্জিও লিখেছেন, “আক্রান্ত ও তুলনামূলক দুর্বল ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা জগতের সহানুভূতি থেকেই আমরা যুদ্ধে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতিকে বাড়িয়ে বলছি। তাদের রণকৌশলের ভুল ব্যাখ্যা করছি, কিছু আনাড়ি মনোবিদ আবার রঙ ছড়িয়ে বলছেন, পুতিন নাকি পাগল হয়ে গেছেন।”

কিন্তু, নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- রাশিয়া হয়তো প্রথমেই চরম আঘাত হানতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটি যথেষ্ট না হলে পরবর্তীতে কী করা হবে- তা নিয়ে মস্কোর সুচিন্তিত পরিকল্পনাও আছে।

রজ্জিও দীর্ঘদিন মার্কিন সেনাবাহিনীতে একজন পদাতিক সেনা এবং সিগন্যালম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। সামরিক কৌশল বিশ্লেষণে তার দক্ষতাও সুবিদিত।

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, “সেই কৌশল কী আমাদের তা নিশ্চিত জানা নেই। কিন্তু পুতিনের কার্যকলাপ প্রমাণ করছে, তিনি একজন ঠাণ্ডা মাথার ও হিসেবি প্রতিদ্বন্দ্বী।”

ইউক্রেনে হা’মলার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পুতিন উন্মাদ এমন আরোপকে পুরোপুরি নাকচ করে বিল রজ্জিও বলেন, “এগুলো তার বিরোধিতার বাহানা এবং ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের সমালোচনার ভিত্তি তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

ভবিষ্যতে পুতিন পোল্যান্ড, মলদোভা, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া এবং চেক রিপাবলিকসহ বাল্টিক সাগর তীরের সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাতে পারেন।

এর আগে ২০০৮ সালে জর্জিয়ার একাংশ দখল করেন পুতিন। এই দখলদারি ন্যাটো আর পশ্চিমা বিশ্বকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের বেলাতেও তারা কিছু করতে পারেনি। তাই হয়তো নির্ঘাত ন্যাটো জোটে দুর্বলতার গন্ধ পেয়ে গেছেন শিকারী বাঘের মতো সুযোগ-সন্ধানী পুতিন। তিনি ন্যাটোকে একটি ভারাক্রান্ত, দুর্বল আর কাগুজে বাঘ হিসেবেই দেখছেন।